
ঘন কুয়াশা, দু-একটা গাড়ি হেডলাইটের আলো জ্বালিয়ে আর বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে ছুটে যাচ্ছে।
লোকজনের আনাগোনা খুবই কম। কয়েকজন টোকাই আগুন জ্বালিয়ে শীতের প্রকোপ দূর করার চেষ্টা করছে।
৬ ডিসেম্বর সকাল আটটায় চারুকলার সামনের দৃশ্যটা ছিল এমনই। এরই মধ্যে এলেন তিশা ও মোশাররফ করিম। যাঁরা সকালবেলা হাঁটাহাঁটি করতে আসেন, তাঁদের কেউ কেউ দুজনকে একসঙ্গে দেখে থমকে দাঁড়াচ্ছেন। পরখ করে নিচ্ছেন, আসলে এঁরা মোশাররফ করিম ও তিশা কি না?
দুজনকে ঘিরে ছোটখাটো একটা জটলা হচ্ছে। আবার জটলা কেটেও যাচ্ছে। ব্যাপারটা অবশ্য দুজনই বেশ উপভোগ করছেন।
আলোকচিত্রী খালেদ সরকারের ক্যামেরায় দুজনই তখন ব্যস্ত ছবি তোলায়। তবে ছবি তোলার আগে তিশা থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার-এর টিশার্ট পরে নিলেন। মোশাররফও একই ধরনের টিশার্ট পরে নিলেন। আগামীকাল শুক্রবার তাঁদের দুজনের অভিনীত এ ছবিটি মুক্তি পাবে। তাই তাঁরা এখন এ ছবির প্রচারণা নিয়ে ব্যস্ত।
ছবি তুলতে গিয়েও কিছুটা বিপত্তি। আলো নেই। কুয়াশার চাদরে বারবার ঢাকা পড়ে যাচ্ছেন তিশা ও মোশাররফ।
এভাবেই কেটে গেল আধা ঘণ্টা। দুজনই বসলেন। শোনালেন তাঁদের কিছু কথা, কিছু গল্প। এর পুরোটাই ছিল থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার।
ছবিটি আগামীকাল মুক্তি পেলেও এ ছবির গান কিন্তু অনেক আগেই শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে। কথা হলো গান নিয়ে।
মোশাররফ বললেন, ‘অসাধারণ গান। ছবিতে পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী গল্পের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী গানটি এত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন যে, দর্শকেরা খুবই রোমাঞ্চিত হবেন। সত্যি বলতে কি, এক একটি দিন যাচ্ছে, আর নিজের মধ্যে অস্থিরতা যেন আরও বাড়ছে। মনে হচ্ছে, কবে ছবিটি মুক্তি পাবে আর বুকের ভেতর আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা কখন ছাড়ব এবং স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নেব। কারণ প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কিছু স্বপ্ন থাকে, সেই স্বপ্ন অনেক দিন লালন করার পর যখন বাস্তবায়িত হয়, তখন তার মধ্যে যে আনন্দ হয়, তা অপরিসীম। এটাকে আসলে বোঝানো যায় না, শুধুই উপলব্ধি করা যায়। ঠিক এ ছবিটি নিয়ে আমার মধ্যেও এসব ক্রিয়া কাজ করছে।’
তিশা বললেন, ‘গান তো মানুষ পছন্দ করেছেই। নিশ্চিত করে বলতে পারি, একটি ভালো ছবি, বিনোদনে ভরপুর ছবি মানুষ দেখবে অনেক আনন্দ নিয়ে। আর এটি আমার প্রথম ছবি। আমার মনে আছে, চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য অনেক দিন থেকেই আমাকে অনেকেই বলেছেন। আমি অপেক্ষায় ছিলাম, কবে একটা ভালো চরিত্র পাব, যেখানে আমি তিশা একটু অন্যভাবে আসতে পারব। সেই সুযোগটি হয়েছে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার ছবি দিয়ে। আমি খুবই খুশি যে, এত দিন যে ছবির জন্য কষ্ট করেছি, সেই ছবিটি এবার মুক্তি পেতে যাচ্ছে। মজার বিষয় হচ্ছে, আমি সাধারণত যেভাবে অঙ্গভঙ্গি করি, এ ছবি করার আগে দুই মাস অনুশীলন করে সেসব পাল্টালাম। কিন্তু এ ছবির শুটিংয়ের পর যখন আবার নাটকের কাজ করতে গেলাম, তখন আরেক ধরনের সমস্যা হলো। যেখানেই কাজ করতে যাই, সেখানেই থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার-এ যে অঙ্গভঙ্গি করেছি, তা-ই ঘুরেফিরে আসতে শুরু করল।’
মোশাররফ আগেভাগেই তাঁর অন্য পরিচালকদের বলেছিলেন, তিনি তাঁর গেটআপে পরিবর্তন আনতে চুল ছোট করে ফেলেন। তাই সেভাবেই সবকিছু মাথায় রেখে নাটকের পরিচালকেরা কাজ করেছেন। ‘কিছুই করার ছিল না। কারণ ওই যে বললাম, একটা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতেই আমি কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করার চেষ্টা করেছিলাম মাত্র। এখন যদি সেই ছবিটি সবার কাছে ভালো লাগে, তবেই খুশি হব।’ বলছিলেন মোশাররফ।
এবার ছবি প্রসঙ্গে আসা যাক। ছবিটিতে আছে দুটি গল্প। প্রথমত একটি মেয়ে সমাজে একা একা চলাফেরা করতে গিয়ে ঠিক কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়ে। সমাজের মানুষগুলোই বা মেয়েটিকে কী চেখে দেখে? তার সামাজিক অবস্থানটা কোথায় থাকে। মেয়েটির জীবনে একসময় আসে ভালোবাসা। কিন্তু ভালোবাসার মানুষটি খুনের দায়ে জেলে অন্তরিণ হয়। তখনই মেয়েটির জীবনে নেমে আসে আরেক দফা বিপর্যয়। প্রতিকূলতাকে ছাপিয়ে মেয়েটি বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করে।
দ্বিতীয় ধাপে দেখা যায়, ভালোবাসার মানুষটি ফিরে আসে মেয়েটির কাছে। কিন্তু ততক্ষণে যেন সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যায়। ছেলেটির মনে সন্দেহ হয় মেয়েটিকে নিয়ে। এবার মেয়েটি মনঃকষ্টে পুড়তে থাকে। শুরু হয় আরেক দফা যুদ্ধ। সে তাহলে এখন কী করবে?
আনিসুল হকের রচনায় মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এমনই একটি গল্প নিয়ে নির্মাণ করেছেন থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার।
মেয়েটির নাম রুবা। ছেলেটির নাম মুন্না। তাদের সম্পর্কটা কী? কেউ মনে করতে পারেন, তারা স্বামী-স্ত্রী, কেউ বা মনে করতে পারেন, তারা প্রেমিক-প্রেমিকা। রুবা চরিত্রে রূপদানকারী তিশা বলেন, ‘আসলে এটা দর্শকেরাই খুঁজে নেবেন যে, মুন্নার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক। তবে আমরা একটা চমক রেখেই কাজটা করেছি।’
মুন্না চরিত্রে কাজ করেছেন মোশাররফ। বললেন ছবির শুটিং করার একটি ছোট্ট গল্প। ফারুকী ভাই আমাকে একটি দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দিলেন। বললেন, ‘তোমার সামনে তিশা থাকবে না। থাকবে একটি পুতুল। তুমি মনে করবে, ওই পুতুলটি হচ্ছে তোমার তিশা। তুমি পুতুলকে তিশা মনে করে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে।’ সত্যি বলতে কি, এমন পরিস্থিতির শিকার আমি এর আগে কখনো হইনি। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে, একটি পুতুলকে জড়িয়ে ধরে আবার একজন মানুষ কাঁদে কীভাবে?
যা হোক, লাইট, ক্যামেরা সবই প্রস্তুত। কান্না আর আসে না। জোর করে কাঁদতে গেলেও আবার লাইটম্যানরাই হেসে দেন। কী যে এক বিড়ম্বনায় পড়লাম। একবার খুব বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লাম। পুতুলটাকে জড়িয়ে কেঁদেও দিয়েছি। এ সময় ক্যামেরাম্যান বললেন, ‘দুঃখিত, রানআউট হয়ে গেছে। অর্থাত্ নেগেটিভ নতুন করে ক্যামেরায় ভরতে হবে। এভাবে একটি দৃশ্যের জন্য না হলেও কম করে হলেও ১৫—২০ বার ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হয়েছে। একটা পুতুল ধরে এতবার কাঁদতে হয়েছে যে, পুতুলটাকে দেখলেই পরে আমার ভয় লাগত।’
তিশারও রয়েছে শুটিংয়ের নানা রকম অভিজ্ঞতা। ‘শুটিং শুরু হলো। শিল্পী হিসেবে ছিলেন তপু। কাশবনে আমাদের শুটিং। আমাদের দৃশ্যটি এমন ছিল যে, আমি আর তপু কাশবনের মধ্যে হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করছি। এই একটি দৃশ্যে কাজ করতে আমাদের সময় লেগেছে পাক্কা দুই দিন। কারণ হচ্ছে, প্রথমত পরিচালক যেভাবে চাচ্ছিলেন, আমরা সম্ভবত সেভাবে কাজটা করতে পারছিলাম না। আবার যেভাবে আমরা কাজটা করতে পারছিলাম, সেভাবে আর ক্যামেরা কাজ করছিল না। একপর্যায়ে তিনটি ক্যামেরা পরিবর্তন করা হলো। এ রকম ঝামেলার জন্যই একটি দৃশ্যের কাজ করতে টানা দুই দিন লেগেছিল আমাদের।’ বললেন তিশা।
তিশার প্রথম ছবি হলেও মোশাররফ এর আগে জয়যাত্রা, দারুচিনির দ্বীপ চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। এখন কি তাঁরা নিয়মিত কাজ করবেন?
মোশাররফ জানালেন, বাণিজ্যিক ছবিতে কাজ করার প্রস্তাব মাঝেমধ্যেই তাঁর কাছে আসে। কিন্তু ডর লাগে; যদি আবার না হয়। হাসতে হাসতে বললেন তিনি। ‘তবে আমি কাজ করব। এফডিসিকেন্দ্রিক ছবিও করব। তবে চরিত্রটা হতে হবে একটু অন্য রকম। ব্যাটে-বলে মিলে গেলেই করব। এর বাইরে আমি প্যারালাল ছবি যেগুলো হয় সেগুলো তো করবই।’ বললেন তিনি।
তিশা অবশ্য নিজেকে বাণিজ্যিক ছবিতে পুরোপুরি উপযোগী মনে করেন না। তিনি বলেন, ‘আসলে আমি হয়তো বেশি ছবি করব না। খুব বেশি হলে সাত থেকে আটটি ছবিতে কাজ করব। সেই ছবিগুলো স্মরণীয় ছবি হয়ে থাকবে। তাই আমি এমন গল্পের ছবি করব, যেগুলো আমাকে একটু অন্যভাবে তুলে আনবে। যেমন একটি হচ্ছে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার।’
কুয়াশা অনেকটাই কেটে গেছে। মানুষজনের আনাগোনা বাড়ছে। মোশাররফের মুঠোফোন কল আসতে শুরু করেছে। তিশাকেও উঠতে হবে। দুজনই বললেন, ‘একটি ভালো ছবি দেখার জন্য বিনোদনপ্রিয় মানুষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। ছবিটি ভালো লাগলে অন্যদের বলতে ভুল করবেন না—প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ...।’