Saturday, December 26, 2009

follow-up: 3psn


চিত্র সমালোচনা
তৃতীয় ছবিতে সংহত ফারুকী
ফাহমিদুল হক তারিখ: ২৪-১২-২০০৯

তৃতীয় ছবি থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার-এ মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে সংহত অবস্থায় পাওয়া গেল। এ ছবিতে মুন্না-রুবা-তপুর ট্রায়াঙ্গুলার অথচ সিঙ্গুলার রিলেশনের কাহিনি দর্শকের মনে গেঁথে যায় এর আধেয় ও আঙ্গিক উভয় বিবেচনাতেই। মোটের ওপর এটি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির ছবি। ব্যাচেলর-এও আধুনিকতা ছিল, কিন্তু তা হাল ফ্যাশনময় এক উপরিতলে ঘুরপাক খায়। কিন্তু থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার-এর সিঙ্গুলার নারী রুবার মনস্তত্ত্বের গভীরে পরিচালকের প্রবেশ করার প্রচেষ্টা ছবিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
রুবার জীবনসঙ্গী (স্বামী নয়) মুন্না কী এক গোলমাল করে খুনের অভিযোগে জেলবন্দী। ছবি শুরু হয়েছে এর পরের ঘটনা থেকে। রুবা এর পর থেকে মোটামুটি ঘরছাড়া। তার মা সাবেক প্রেমিকের সঙ্গে আগেই ঘর বেঁধেছেন। বাবা মারা গেছেন। মুন্না-রুবার বিয়ে নামের প্রতিষ্ঠানকে সম্মান না করার সিদ্ধান্ত যেহেতু মুন্নার বাবা মেনে নিতে পারেননি, তাই জেলে যাওয়ার পরই রুবাকে শ্বশুরবাড়ি ছাড়তে হয়। একা একা ঘুরে শেষে পুলিশের হেফাজতে থানায় এক রাত কাটাতে হয়। পরে আশ্রয় নেয় খালাতো বোনের বাড়িতে। খালাতো বোনের ওখানে থেকেই সে চাকরি ও নতুন বাসা খুঁজতে থাকে।
এ পর্যায়ে দেখা যায়, তাকে অনেকেই বাসা বা আশ্রয় কিংবা চাকরি দিতে চায়, তবে একাকী মেয়ের বিপন্নতার সুযোগে কেবলই তাকে পাওয়ার আশায়। ছবির প্রথম অংশের বেশ খানিকটা সময় বিপন্ন রুবাকে দেখা যায়; সে সংগ্রাম করছে একা বেঁচে থাকার জন্য। এ পরিস্থিতিতে ডিকন নামের এক বড় ভাই তার অ্যাড ফার্মে রুবাকে চাকরি দেয়, সে অংশত অবলম্বন অর্জন করে। তার বিপদ প্রায় পুরোপুরি কেটে যায়, যখন সে তার বাল্যবন্ধু এবং বর্তমানে বিখ্যাত গায়ক তপুর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। তপু প্রথম জীবনে রুবার প্রেমপ্রার্থী ছিল, কিন্তু রুবার অনাগ্রহে তা পূর্ণতা পায়নি। একালে গান গেয়ে বিখ্যাত তপুই রুবার সহায় হয়। তার জন্য অভিজাত এলাকা বসুন্ধরায় ফ্ল্যাট ভাড়া করে দেয় স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে। রুবার দ্বিতীয় লিভ টুগেদার শুরু হয় তপুর সঙ্গে। প্রথম দিকে একই বাসায় দুই রুমে থাকতে থাকতে দুজনই চঞ্চল হয়ে ওঠে। তপু নানা অছিলায় রুবার রুমে টোকা দেয়। রুবাও দুর্বল হয়ে পড়ে, কিন্তু তার আরেকটি ‘সত্তা,’ ১৩ বছর বয়সী রুবা এসে তাকে বাধা দেয়। তার নৈতিকতা-বিবেক ধরে টান দেয়। ছবির বাকি কাহিনি আগেভাগেই আর বলতে চাই না।
শুরুতেই বলেছি, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির ছবি। অর্থাত্ নগরায়ণ ও আধুনিকতার প্রভাবে প্রথাগত অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রতিই নতুন প্রজন্মের মানুষের আস্থা কমতে থাকে, বিয়ে যেমন একটি প্রতিষ্ঠান। নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এই দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন আসে। তবে যতই আধুনিকতা আসুক, নারীর ক্ষমতায়নের সম্ভাবনা যতই বাড়ুক, নারী ও তার শরীর সনাতন ও আধুনিক সব সমাজেই যে লাঞ্চনার শিকার—এই ছবির মূল বক্তব্য এটাই। কিন্তু এসবের মধ্য দিয়েই দৃঢ়চেতা নারীরা এগিয়ে যায়, রুবা যেমন। আর দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন যে অনেক নতুন সংকটের জন্ম দেয়, ছবিতে তাও এড়িয়ে যাওয়া হয়নি। তবে পশ্চিমের তুলনায় সংকটের ধরনে পার্থক্য আছে। নগরায়ণ, আধুনিকতা, বিশ্বায়নের চাপে বাংলাদেশের প্রধান নগর ঢাকায় সনাতন সংস্কৃতি পুরোপুরি উঠে যায়নি, মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা অতটা প্রকট হয়নি। তাই বিবাহ নিবন্ধন না করেও মুন্না ঠিকই বসবাসের জন্য রুবাকে নিয়ে বাবার সামনে গেছে সম্মতির জন্য এবং দুজন ওই বাসায় বসবাসের অনুমতির জন্য। মা পুরোনো প্রেমিকের বাসায় চলে যাওয়ায় রুবার যে ঘৃণা, তাও সনাতনী সংস্কৃতিবাহিত মূল্যবোধের কারণেই।
এ ছবিতে প্রত্যাবর্তন টেলিছবির ফারুকীকে খুঁজে পাওয়া গেল। অর্থাত্ ‘ক্লাসিক্যাল ন্যারেটিভ’ ধারায় গল্প বলার পরিবর্তে চলচ্চিত্রভাষার আশ্রয়ে নিরীক্ষার প্রয়াস লক্ষণীয় এখানে। কাল ও পরিসরকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে চালচ্চিত্রিক সুবিধা নেওয়ার উদ্যোগ স্পষ্ট এ ছবিতে। কার্যকরভাবে ফ্ল্যাশব্যাক ব্যবহারের পাশাপাশি কিছু কিছু স্বপ্নদৃশ্যের মাধ্যমে একটা পরাবাস্তব আবহও তৈরি করা হয়েছে। রুবার মনস্তত্ত্বের গভীরে যাওয়ার জন্য এক রুবাকে ভেঙে তার তিনটি সত্তা তৈরি করা হয়েছে—শিশু রুবা, কিশোরী রুবা ও বর্তমানের রুবা। বিশেষত কিশোরী রুবা বর্তমানের রুবার সঙ্গে প্রায়ই তর্ক করে, তার দৃষ্টিতে বর্তমানের রুবার যেকোনো ‘অনৈতিক’ কাজে বাধা দেয়। আর তাদের তর্কের মাঝখানে শিশু রুবা মন খারাপ করে, কাঁদে। তবে পরাবাস্তব আবহ সবচেয়ে মনোগ্রাহী হয়েছে মায়ের মৃত্যুর পর একটি স্বপ্নদৃশ্য—সবুজ এক বিস্তৃত চত্বরে একটা খাট, খাটে রুবা শুয়ে। সে খাট থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে একটি বড় দিঘির পাশে যায়। দিঘির ওপারে মায়ের আবছা বসে থাকা। মায়ের পেছনে আরও বিস্তৃত প্রান্তর, কিন্তু কুয়াশারহস্যে তার অস্তিত্ব অদৃশ্যমান। লং শটে সবুজ চত্বর-রুবা-দিঘি-মা-কুয়াশারহস্য...একটা পেইন্টিংয়ের গভীরতা ফ্রেমজুড়ে।
দর্শকের মনে রুবার যন্ত্রণার অনুভূতি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য দু-একটা উদ্যোগ অবশ্য অকারণ মনে হয়েছে। মায়ের মৃত্যুর পরপরই রুবাকে পঞ্চম বা ষষ্ঠ তলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখা যায়। রুবা সিঁড়ি বেয়ে নামছে, ৩৬০ ডিগ্রিতে ক্যামেরা চক্রাকারে মুভ করে—শটটা ভালোভাবেই নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই লং টেকের সঙ্গে আগের ও পরের দৃশ্যের কোনো সংস্রব নেই। বিপর্যস্ত চরিত্রের বেহাল দশা দেখাতে সিঁড়ির ব্যবহার একটা অতি পুরোনো আর্ট ফিল্মীয় কায়দা। বিশেষত অত উঁচুতে রুবা কেন উঠল, তার অফিস ওই তলায় কি না—এ রকম কোনো তথ্যই এর আগে বা পরে দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে মুন্নার জেল হওয়ার প্রকৃত কারণ কী, তা স্পষ্ট করে বলার ক্ষেত্রে চিত্রনাট্যকার আনিসুল হক ও মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে অনীহ থাকতে দেখা গেছে। কী কী কারণে তার জেলবাস এতটা সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল, তাও পরিষ্কার করা হয়নি।
ছবিতে ক্যামেরা চালিয়েছেন সুব্রত রিপন। তিনি ক্লোজ শটগুলো ভালো তুলেছেন। আর লো অ্যাঙ্গেল শটের প্রতি যে তাঁর পক্ষপাত রয়েছে, তা ছবিতে স্পষ্ট। তবে লিমনের আবহ সংগীত সুপ্রযোজ্য মনে হয়নি সব স্থানে। ফারুকীকে অভিনন্দন একটি সফল প্রকল্প পরিসমাপ্তির জন্য।

No comments:

Post a Comment